Posted in Scribbled Thought

কলকাতা ভালো আছো?

প্রিয় কলকাতা,
ভালো আছো? জানো আজ তোমাকে বড্ড মনে পড়ছে। মনে পড়ছে, প্রথম যেদিন তোমার কাছে এলাম, সেই দিনটা। আমার মন এতোটুকু ভালো লাগেনি। তোমার প্রতি একটা বিতৃষ্ণা জন্মেছিল অনেক ছোট থেকেই। আসলে মফঃস্বলের মেয়ে তো, ভয় ছিল লোকে যদি হ্যাঁটা দেয়। বড় হয়েছি, পড়াশুনো করতে চলে গেছি ভুবনেশ্বরে। জানো, ওখানের মাটিটা বেশ লাল; ঠিক মেদিনীপুরের মত। ৭ টা বছর কাটিয়েছি ওখানে। তোমার মত অতো কোলাহল নেই। বেশ স্নিগ্ধ শহর। আবার শ্রীক্ষেত্র কাছে ওখান থেকে। তারপর জীবিকার টানে তোমার কাছে আসা।

জানো তিলোত্তমা, সেইদিনটা জুন মাসের মাঝামাঝি বা শেষ হবে। খুব বৃষ্টি পড়ছিল। আমি আমার পোর্টফলিও হাতে ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছি। পাশে মা বসে। নাগপাশের মত সারাজীবন জড়িয়ে রেখেছে আমাকে। ইন্টারভিউ হয়ে গেল। আমার নতুন চাকরি পাকা তখন। ১৫ দিন পর জয়েনিং। আমার আজো মনে আছে, প্রভম বলেছিল, ‘দিদি কংগ্রাচুলেশনস। ফাটিয়ে দিয়েছ তো।’ বিশ্বাস কর কোলকাতা, আমার একটুও ভালো লাগেনি। ভালো লাগেনি তোমার প্যাঁচালো পরিবেশ। ভয় ছিল, এখানে মানাবো কি করে? এখানে তো আমি বেমানান। রাস্তাঘাটের গাড়িঘোড়া বড্ড ভয়ঙ্কর। যাই হোক, আমার চাকরিজীবন শুরু হল।

ও বাবা, অফিসে গিয়ে দেখি, আমিতো একদম হংস মধ্যে বক যথা। বাঙালি হয়ে ফুটবল জানিনা। মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গলের জার্সি গুলিয়ে ফেলেছিলাম বলে সেকি হাসাহাসি অফিসে। আমি বাঙলা সিনেমা দেখিনি। বাংলা গানে কোনো উৎসাহ নেই। আমি কথায় কথায় ‘বাল’ বলতে পারি না। আমি গালিটা ইংলিশে দিতাম। আমি তো কোরিয়ান ফিল্মের ভক্ত। আমার ভাণ্ডারে ইংলিশ গানের সংগ্রহ। আমরা ‘গেম অফ থ্রোনস’, ‘বিগ ব্যাং থিওরি’ এসব দেখতাম। স্বাভাবিক, ভুবনেশ্বরের হস্টেলে সব চলত। আর গোটা সময়ই আমি কাটিয়েছি বিহারি রুমমেটের সাথে। মেয়েটা আজ অনেক বড় জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। অসাধারন গান গাইত আর হাতের কাজ জানত। তারপর দেখলাম বাঙ্গালিকে সাধে কাঁকড়ার জাত বলেনা। আমার পিজির মাসি শুরুতে বড় মিস্টি কথা বলেছিল। কিন্তু বাস্তবে ব্যাবহার ভালো না। তারপর শুরু হল আমার মনের মানুষ খোঁজা। মুঠোফোনের দৌলতে এক আশ্চর্য প্রদীপ পেলাম। তাতে রোজ নতুন লোকের সন্ধান পাই। শুনেছিলাম তুমি প্রেমের শহর। তোমার ব্যাপ্তিতে ছড়িয়ে আছে প্রেমিকের আলিঙ্গন। সেখানেও চরম ঠকে গেলাম। হায়! প্রেমিক কই? সব তো পুরুষ। যারা প্রতি মুহূর্তে জরিপ করে দেহসৌষ্ঠব। কেউ বা শুধু প্রেমের স্বপ্ন দেখায়। জানো তিলোত্তমা, তোমাকে আরও ঘেন্না হত।

তারপর একদিন একটা মানুষের সাথে আলাপ হল। মানুষটাকে বড্ড আত্মঅহঙ্কারি লেগেছিল। ঠোঁটে সিগারেট আর চায়ের অসম্ভব নেশা। আমাকে বলেছিল, “আপনি কোনদিন কফিহাউসে গিয়েছেন? বা অঞ্জন দত্তের গান শুনেছেন? পুরো নস্টালজিয়া।” মানুষটা তোমাকে ভালবাসতে শেখাল।
আমি বলতাম শবরবাবু আর আমাকে বলতেন জগবন্ধু। আমাকে প্রথমবার কুমারটুলী নিয়ে গেল সে। কাশী মিত্তিরের ঘাট পেরিয়ে আমরা হাঁটতাম আহিরীটোলার ঘাটের দিকে। গঙ্গার জলে পা ডুবোতাম। হাওড়ার দিক থেকে ভেসে আসতো আরতির ঘণ্টার আওয়াজ। শবরবাবু আমাকে নিয়ে গেছেন নন্দনে, প্রিন্সেপ ঘাটে, উত্তর কোলকাতার অলিগলিতে। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখেছি তোমার সৌন্দর্যে। রবীন্দ্র সরোবরে চা আর পাপড়ি চাট খেতে খেতে তর্ক করেছি কত। আজো ভুলিনি বাগবাজারের ছানার ডালনা; কি কেবিনের অসাধারন ভেটকি ফ্রাই। আজও ভুলিনি সেই দিনটা যেদিন আমি আর উনি আবিরকে দেখবো বলে চা ফেলে দৌড়েছিলাম।
কোলকাতা, তারপর এল আমার আরেক বন্ধু। তার হাত ধরে প্রথম থিয়েটার দেখলাম। যাদবপুরের ফুটপাথে বসে চা আর মোমো। দুঃখের সময়ে আশ্রয় পেয়েছি তার কাছে। কত দুষ্টুমির সাক্ষী থেকেছ আমাদের। বুঝিনি কখন আমরা মনের কাছাকাছি এসে পড়েছি। একটা নতুন সম্পর্ক এল আমার জীবনে। এই প্রথম একটা দাদা পেলাম। একটা সত্যি দাদা। আর ছিল বেহালায় আমার সখা। যার সাথে আড্ডায় বসলে কারুর সময়ের আর সিগারেটের হুঁশ থাকতো না। কিংবা আমার সেই ফোটোগ্রাফার বন্ধু; যার সাথে কাঠগোলায় ফুচকা খেতাম। তার সাথে পার্কের বেঞ্চিতে কাটিয়েছি কত বিকেল গল্প করে।

আজ তোমাকে বড্ড মনে পড়ছে কোলকাতা। কেমন আছো? আজ একটা মারণ রোগে পৃথিবী ভুগছে। আমি আজ ২ মাস গৃহবন্দী। শবরবাবুও বন্দী। শুধু আমার দাদাটা দৌড়ে বেড়াচ্ছে রোগীর কাছে কাছে। সেতো ডাক্তার, তার তো বন্দিত্ব নেই। ওগো তিলোত্তমা, আমি আবার আহিরীটোলার ঘাটে বসতে চাই। আমি যাদবপুরের ফুটপাথে চা খেতে চাই। আমি সল্টলেকের রাস্তায় হাঁটতে চাই। দেখতে চাই ওইখানের আমগাছগুলোতে কেমন আম হল? এখন আর তুমি দুরূহ উপন্যাস নও কোলকাতা। এখন চিনে গেছি বাসগুলো। আমি মিস করছি আমার রোববারের সকালের মর্নিং শো। কালিকাপুরের রাস্তায় কেমন ফুল ফুটেছে, জানতে মন করছে বড্ড। আচ্ছা শঙ্কুদা কি এখনও অমনি গাঢ় চা বানায়? বড্ড মিস করছি, এসি ৩৭এ করে নিউটাউন যাওয়াটা। কোলকাতা, জানতে মন করছে পার্কস্ট্রিটে, মেট্রো স্টেশনের কাছের মুচিটার দিন চলছে কি করে কিংবা গড়িয়ার ওই ধোপাটা, যে যত্ন করে আমার জামা ইস্ত্রি করত। আজো ভুলিনি বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া সেই দিনটা, ওর সাথে প্রথম দেখার দিন। অজান্তে ওকে ভালবাসতে বাসতে, কখন তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি, বুঝতে পারিনি। আজ সে আমার জীবনে অতীত কিন্তু তুমি বেঁছে আছো প্রবলভাবে।

ভালো থেকো কোলকাতা। তোমাকে আবার জড়িয়ে ধরব দুহাতে। আবার ঘুরে আসব অনেক জায়গা। রাস্তা ভুলে গেলে চায়ের দোকানে ঠিকানা জেনে নেব। দৌড়ে ধরে নেব বাস। বাড়ি ফেরার তাড়া থাকলে মেট্রো কার্ড ঘষে পাতাল ফুঁড়ে উঠে আসব। আবার আমি সূর্যাস্ত দেখবো নৌকায় বসে; হয়তো নতুন কারুর সাথে।
ততদিন ভালো থেকো।
ইতি
তোমার এক প্রেমিকা